শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস ও এর ফজিলত কি জানেন?
পূর্বের নবী-রাসূলদের উম্মতগণ আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর উম্মতগণ হতে অনেক বেশি হায়াত পেতেন। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় আখেরি বান্দাদেরকে অধিকতর প্রাধান্য দিতে শবে কদর, শবে বরাতের মত দামি রজনী দান করেছেন, যেন অল্প আমলে অধিক নৈকট্য হাসিল করতে পারে। তাই আমাদের উচিত শবে বরাতের নামাজের নিয়ম ও আদায় পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে সঠিকভাবে আমল করা।
শা’বান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাত্রিকে শবে বরাত বলে। “শব” ফার্সী শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে রাত্রি। “বরাত” আরবী শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে মুক্তি বা নিষ্কৃতি। শবে বারাআতকে আরবীতে বলা হয় লাইলাতুল বারাআত।অর্থাৎ মুক্তির রাত্রি বা নিষ্কৃতির রাত্রি।
যেহেতু এ রাত্রিতে বান্দা আল্লাহ পাকের দরবারে তাওবা ইস্তিগফার করে যাবতীয় পাপ থেকে মুক্তি লাভ করবে, তাই এ রাত্রিকে বলা হয় লাইলাতুল বারাআত। হাদীস শরীফে এ রাত্রির অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
হাদীস শরীফে এ রাত্রির নাম লাইলাতুল বারাআত কিংবা শবে বারাআত বলে উল্লেখ নেই। হাদীসের ভাষায় বলা হয়েছে নিসফে শা’বান অর্থাৎ শা’বান মাসের অর্ধ রজনীর রাত্রি।
পবিত্র কুরআনেও লাইলাতুল বারাআত বলে কোন উল্লেখ নেই। পবিত্ৰ কুরআনের ১০ম পারায় সূরা-তাওবার ১ম আয়াতে বারাআত শব্দটি রয়েছে। বারাআত শব্দটি উক্ত আয়াতের প্রথম শব্দ। সেখানে বারাআত শব্দটি সম্পর্ক ছেদ করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ।
এছাড়া পবিত্র কুরআনে লাইলাতুল মুবারাকা অর্থাৎ বরকতময় রজনী বলে উল্লেখ আছে। যেমনঃ ২৫ পারায়, সূরা-দুখান এর ৩ নম্বর আয়াতে লাইলাতুল মুবারাকা উল্লেখ রয়েছে।
শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস
১ম হাদিস
হযরত আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ অর্ধ শা’বানের রাত্রিতে (শবেবরাতে) আল্লাহ তায়ালা (নিকটতম আসমানে) অবতীর্ন হন এবং ক্ষমা করে দেন তাঁর সকল সৃষ্টিকে – মুশরিক ও বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ব্যক্তি ব্যতীত {ইবনে মাযাহ}।
২ম হাদিস
শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে হাদীস থেকে জানা যায়।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, একদা রাত্রিতে আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে পেলাম না। তাকে তালাশ করতে করতে হঠাৎ দেখি, তিনি বাকী নামক কবরস্থানে আছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, আয়েশা তুমি কি মনে করেছ যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল তোমার প্রতি কোন অবিচার করেছেন? আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ) নিঃসন্দেহে আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি আপনার অপর কোন স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শা’বানের রাত্রিতে পৃথিবীর নিকটতম আসমানে অবতীর্ন হন এবং বনূ কলব গোত্রের মেষপালের পশম সংখ্যক এবং তার অধিক ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন। (বর্ণিত আছে বনূ কলব গোত্রে প্রায় বিশ হাজার বকরী ও মেশ ছিল।) (আজ সেই রাত্রি) – {তিরমিযী ও ইবনে মাযাহ}
(ইমাম তিরমিযী বলেন, আমি ইমাম বুখারীকে হাদীসটিকে যয়ীফ বলতে শুনেছি )
শবে বরাতের ফজিলত নিয়ে হাদিস
৩য় হাদিস
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, (হে আয়েশা) তুমি কি জান এ রজনীতে অর্থাৎ অর্ধ শা’বানের রজনীতে (শবে বরাতে) কি কি ঘটে? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, তাতে কি ঘটে?
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, এতে নির্ধারিত হয় এ বৎসর মানুষের যত সন্তান জন্ম লাভ করবে। এতে নির্ধারিত হয় এ বৎসর মানুষের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে। এতে উঠানো হয় (নির্ধারিত হয়) মানুষের কর্মসমূহ এবং এতে অবতীর্ন হয় (নির্ধারিত হয়) মানুষের রিযিকসমূহ।
অতঃপর হযরত আয়েশা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, কোন ব্যক্তি কি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না আল্লাহ পাকের রহমত ব্যতীত? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তিনবার করে বললেন, কোন ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না আল্লাহ পাকের রহমত ব্যতীত ।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনিও নহে ইয়া রাসূলাল্লাহ? তখন তিনি আপন মাথার উপর হাত রেখে বললেন, আমিও না। কিন্তু যদি আল্লাহ তায়ালা আপন রহমত দ্বারা আমাকে ঢেকে লন-ইহা তিনি তিনবার বললেন। — {মিশকাত শরীফ}
(কোন কোন হাদীসে এ সকল বিষয় শবে কদরে সংঘটিত হয় বলে উল্লেখ আছে)।
৪র্থ হাদিস
হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যখন অর্ধ শা’বানের রজনী (শবে বরাত) আসবে, উহার রাত্রিতে তোমরা নামাজ আদায় করবে এবং দিনে তোমরা রোযা রাখবে। কেননা উহাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথেই আল্লাহ তায়ালা এ নিকটতম আসমানে অবতীর্ন হন এবং বলতে থাকেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছ কি-যাকে আমি ক্ষমা করে দিব, কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছ কি যাকে আমি রিযিক প্রদান করব এবং কোন বিপদগ্রস্থ আছ কি যাকে আমি বিপদ মুক্ত করব। এভাবে আরো ব্যক্তিকে ডাকেন, যে যাবত না ফজর হয় {ইবনে মাযাহ}।
শা’বান মাস সম্পর্কে হাদিস
৫ম হাদিস
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অন্যান্য মাসের তুলনায় শা’বান মাসে অধিক রোযা রাখতেন (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রজব ও শা’বান মাসদ্বয়ের জন্য এ দোয়া করতেনঃ
বাংলা উচ্চারণঃ- আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রজবা ওয়া শা’বান ওয়া বাল্লিগনা ইলা শাহরি রমাযান ।
অর্থঃ হে আল্লাহ, আমাদের জন্য রজব ও শা’বান মাসে বরকত নাযিল করুন, আর আমাদেরকে রমযান মাস পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।
{বায়হাকী}
বর্ণিত আছে
একদা হযরত ঈসা (আঃ) সফর করছিলেন। হঠাৎ উঁচু পাহাড়ে উঠে গেলেন এবং উচচ শিখরে দুধের চেয়েও অধিক সাদা একটি পাথর দেখলেন। হযরত ঈসা (আঃ) উক্ত পাথরের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে তার চতুর্দিকে ঘুরতে লাগলেন। হঠাৎ আল্লাহ তায়ালা ওহী পাঠলেন, হে ঈসা, তুমি কি এর চেয়ে অধিক আশ্চর্যজনক জিনিস দেখতে চাও?
হযরত ঈসা (আঃ) বললেন, নিশ্চয়ই দেখতে চাই হে আল্লাহ। হঠাৎ পাথরহানা ফেটে গেল। তিনি দেখতে পেলেন, একজন বুযুর্গ আল্লাহ পাকের ধ্যানে মগ্ন যার দেহে পশমের জুব্বা, হাতে লাঠি, সম্মুখে আংগুর প্রভৃতি ফলাদি। হযরত ঈসা (আঃ) অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে বুযুর্গ আপনি কে এবং কতদিন যাবত এখানে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন আছেন ? আপনার সম্মুখের ফলাদি কোথা থেকে এসেছে?
বুযুর্গ উত্তর করলেন, আমি একজন সাধারণ মানুষ। মায়ের দোয়ায় আল্লাহ তায়ালা আমাকে এ বুযুর্গী দান করেছেন । চারশত বছর যাবত এ পাথরের ভিতরে আল্লাহ পাকের ইবাদত করছি । প্রত্যহ আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে আমার জন্য এ ফলাদি পাঠানো হচ্ছে। এ কথা শুনে হযরত ঈসা (আঃ) বললেন, হে আল্লাহ জাল্লা শানুহু, আমার মনে হয় এ ব্যক্তির চেয়ে উত্তম কোন বুযুর্গ ব্যক্তি আপনি সৃষ্টি করেননি।
আল্লাহ তায়ালা ওহী পাঠালেন, হে ঈসা, জেনে রাখ আমার প্রিয় হাবীব খাতামুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদ দিবাগত রাত্রিতে ইবাদত করবে তার ইবাদত আমার এ বুযুর্গের চারশত বছরের ইবাদতের চেয়েও অধিক পছন্দনীয়। একথা শুনে হযরত ঈসা (আঃ) আফসোস করে বললেন, হে আল্লাহ আমি যদি খাতামুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উম্মত হতে পারতাম {কালয়ুবী}।