ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়ম [নিয়ত, তাকবীর ও ফজিলত] জেনে নিন
প্রত্যেক জাতিরই আনন্দ-উৎসবের কিছু বিশেষ দিন থাকে। ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দুইটি পবিত্র ও আনন্দঘন দিন উপহার দিয়েছেন—ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা। এর মধ্যে ঈদুল ফিতর আসে রমজানের আত্মশুদ্ধির মাস শেষে, শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে। আর ঈদুল আজহা পালিত হয় জিলহজ মাসের দশম দিনে, কুরবানির ত্যাগের শিক্ষা নিয়ে।
এই দুটি ঈদ শুধু আনন্দ উদযাপনের মাধ্যম নয়, বরং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিশেষ সুযোগ। ইসলামী শরিয়তের আলোকে এই দিনগুলোতে নির্দিষ্ট নিয়মে দু’রাকাত ঈদের নামাজ আদায় করা হয়, যা একদিকে আনন্দের প্রকাশ, অন্যদিকে আত্মিক প্রশান্তির এক অনন্য উপলক্ষ।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ঈদুল ফিতরের নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো—নিয়ত, নামাজের নিয়ম-কানুন, অতিরিক্ত তাকবীরসমূহ এবং এর ফজিলতসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। পুরো আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পাবেন। ইনশাল্লাহ”
ঈদুল ফিতরের ফজিলত
হযরত আউস আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ-
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ঈদুর ফিতরের দিন সকালে সকল ফিরিশতা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, হে মুসলিমগণ, তোমরা দয়ালু প্রতিপালকের দিকে আসো। উত্তম প্রতিদান ও অনেক সওয়াব প্রাপ্তির জন্য আসো।
তোমাদের রাত্রিবেলার নামাজের নির্দেশ দেয়া হলে তোমরা সে নির্দেশ মেনে নামাজ আদায় করেছ। তোমাদেরকে দিনগুলোতে রোজা রাখতে বলা হলে তোমরা সে নির্দেশও পালন করেছ, এক মাস রোজা রেখেছ। গরীব দুঃখীদের পানাহারের মাধ্যমে নিজ প্রতিপালককে তোমরা পানাহার করিয়েছ। এখন নামাজ পড়ার মাধ্যমে এগুলোর প্রতিদান ও পুরস্কার গ্রহণ কর।
ঈদের নামাজ পড়ার পর ফিরিশতাগণের মাঝে একজন ঘোষণা দেন, শোন নামাজ আদায়কারীরা, তোমাদেরকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন মাফ করে দিয়েছেন, সকল গুনাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাও। আর শোন, এ দিনটি হচ্ছে পুরস্কার প্রদানের দিন। আসমানে এ দিনের নামকরণ করা হয়েছে পুরষ্কারের দিন-।
(তাবারানী)
ঈদুল ফিতরের সুন্নত সমূহ
ঈদের দিনে রয়েছে বেশ কিছু সুন্নত ও মুস্তাহাব কাজ, যা পালন করলে ঈদের দিনটি হয়ে ওঠে আরো বরকতময়, তাই ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়ম ও নিয়ত সম্পর্কে জানার আগে চলুন ঈদুল ফিতরের সুন্নত ও নফল আমল সমূহ সম্পর্কে খানিকটা জানা যাক।
- নিজ মহল্লাহর মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করা।
- মিসওয়াক করা।
- গোসল করা।
- খুশবু লাগানো।
- সাদাকায়ে ফিতর যার উপর ওয়াজিব তা নামাজের পূর্বেই আদায় করে দেয়া।
- সাধ্যানুযায়ী উত্তম পোশাক পরা।
- খুশী ও আনন্দ প্রকাশ করা। এটি প্রকাশ করার অন্যতম মাধ্যম হতে পারে সোশ্যাল মিডিয়াঃ যেখানে খুব সহজে বন্ধুদের ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর মাধ্যমে তা প্রকাশ করতে পারেন।
- ঈদের ময়দানে নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পূর্বে ঈদুল ফিতরের দিন কিছু খাওয়া, আর ঈদুল আজহার দিন কুরবানীর পূর্বে কিছু না খাওয়া।
- সামর্থ অনুযায়ী দান সাদাকা করা।
- যত শীঘ্র ঈদগাহে যাওয়া।
- ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া এবং এক পথে যাওয়া অন্য পথে ফিরে আসা।
- ঈদগাহে যাওয়ার সময় চুপে চুপে তাকবীরে তাশরীক বলা । (অর্থাৎ আল্লা-হু আকবার আল্লা-হু আকবার, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু; আকবার আল্লা-হু আকবার, ওয়া লিল্লা-হিল হামদ)।
ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়ত
ঈদের নামাজের নিয়ত আরবি কিংবা বাংলা—যেটা সহজ হয়—সেই ভাষায় সহি শুদ্ধভাবে করা যায়। নিচে ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়ত আরবি ও বাংলায় দেওয়া হলোঃ
আরবিঃ
نَوَيْتُ أنْ أصَلِّي للهِ تَعَالىَ رَكْعَتَيْنِ صَلَاةِ الْعِيْدِ الْفِطْرَ مَعَ سِتِّ التَكْبِيْرَاتِ وَاجِبُ اللهِ تَعَالَى اِقْتَضَيْتُ بِهَذَا الْاِمَامِ مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيْفَةِ اللهُ اَكْبَرْ
বাংলা উচ্চারণঃ
নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লা-হি তায়া-লা রাকআতাই সালা-তি ঈদিল ফিতরি মাআ’সিত্তাতি তাকবীরা-তি ওয়াজিবুল্লা-হি তায়া-লা ইকতাদাইতু বিহা-জাল ইমা-মি মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি- “আল্লাহু আকবার”
বাংলা নিয়তঃ
আমি কেবলামুখী হয়ে ইমামের পিছনে ঈদুল ফিতরের ২ রাকাত ওয়াজিব নামাজ অতিরিক্ত ৬ তাকবীরের সাথে আদায় করছি। “আল্লাহু আকবার”
ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়ম
ঈদুল ফিতরের নামাজের রয়েছে কিছু বিশেষ নিয়ম ও পদ্ধতি, যা সাধারণ নামাজ থেকে কিছুটা ভিন্ন। তাই সঠিকভাবে আদায়ের জন্য এর নিয়মগুলো জেনে রাখা জরুরি।
- প্রথমে ইমামের পিছনে কিবলামুখী হয়ে কাতার সোজা করে দাঁড়াবেন। অতঃপর ঈদের নামাজ আদায়ের নিয়্যাত করবেন।
- অতঃপর দুই কান পর্যন্ত দুই হাত উঠাবেন। ইমামের তাকবীর বলার পর তাকবীর বলে অর্থাৎ “আল্লাহু আকবার” বলে অন্যান্য নামাজের ন্যায় তাহরীমা বাধঁবেন। এ তাকবীরকে বলা হয় তাকবীরে তাহরীমা।
- অতঃপর সানা অর্থাৎ “সুবহানাকাল্লাহুম্মা” দু’আ পাঠ করবেন।
- এরপর ইমামের তাকবীর বলার পর অর্থাৎ “আল্লাহু আকবার” বলে দুই হাত দুই কান পর্যন্ত উঠাবেন। এরপর হাত ছেড়ে দিবেন, তিনবার “সুবহানাল্লাহ” পড়ার পরিমাণ অপেক্ষা করবে (এটি হচেছ প্রথম তাকবীর)।
- অতঃপর আবার ইমাম তাকবীর বলার পর অর্থাৎ “আল্লাহু আকবার” বলে দুই হাত দুই কান পর্যন্ত উঠাবেন। এরপর হাত ছেড়ে দিবেন, তিনবার “সুবহানাল্লাহ” পড়ার পরিমাণ অপেক্ষা করবেন (এটি দ্বিতীয় তাকবীর)।
- অতঃপর পুনরায় ইমামের তাকবীর বলার পর তাকবীর বলে দুই হাত দুই কান পর্যন্ত উঠাবেন। এবার নাভীর উপর হাত বাঁধবেন। (এটি তৃতীয় তাকবীর)।
- অতঃপর ইমাম আস্তে আস্তে পূর্ণ আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পড়ার পর উচচ স্বরে সূরা ফাতিহা ও অন্য কোন সূরা পাঠ করবেন এবং মুকতাদীগণ কোন সূরা পাঠ করবে না বরং ইমামের কিরাআত মনোযোগ সহকারে শ্রবন করবে।
- ইমাম সূরা পড়ার পর অন্য সকল নামাজের ন্যায় রুকু সিজদার মাধ্যমে প্রথম রাকআত সম্পন্ন করবেন এবং তাকবীর অর্থাৎ “আল্লাহু আকবার” বলে দ্বিতীয় রাক উদ্দেশ্যে দাঁড়াবেন।
- অতঃপর ইমাম সূরা ফাতিহা পড়বেন এবং এর সাথে অন্য কোন সূরা মিলাবেন আর মুকতাদীগণ তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করবে।
- এরপর ইমাম অতিরিক্ত তিনটি তাকবীর বলবেন। প্রত্যেক তাকবীরের সময় দুই হাত কান পর্যন্ত উঠাবেন এবং প্রতিটি তাকবীরের পর হাত ছেড়ে রাখবেন (হাত ছেড়ে রাখা অবস্থায় তিনবার “সুবহানাল্লাহ” পড়ার পরিমাণ অপেক্ষা করবেন) মুকতাদীগণও ইমামের সাথে অতিরিক্ত তিনটি তাকবীর বলবে (মনে মনে)। প্রত্যেক তাকবীরের সময় দুই হাত কান পর্যন্ত উঠাবেন এবং হাত ছেড়ে দিবেন।
- অতঃপর এভাবে হাত ছেড়ে রাখা অবস্থাতেই ইমাম চতুর্থবার তাকবীর বলে রুকুতে চলে যাবেন এবং এরপর যথারীতি সিজদা, আত্তাহিয়্যাতু, দরুদ শরীফ ও দু’আ মাসূরা পাঠ করে নামাজ শেষ করবেন। মুকতাদীগণও অন্যান্য নামাজের ন্যায় ইমামের ইকতিদা করবে।
ঈদুল ফিতরের তাকবীর
الله أكبر الله أكبر، لا إله إلا الله والله أكبر الله أكبر ولله الحمد
বাংলা উচ্চারণঃ আল্লা-হু আকবার আল্লা-হু আকবার, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু; আকবার আল্লা-হু আকবার, ওয়া লিল্লা-হিল হামদ।
ঈদের নামাজ সুন্নত নাকি ওয়াজিব?
ইমামে আজম হযরত ইমাম হানিফা (রহঃ) বিভিন্ন হাদীস পর্যালোচনা করে বলেছেন, ঈদের নামাজ ওয়াজিব। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) এরও একই অভিমত। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) ও ইমাম মালিক (রহঃ) এর মতে সুন্নাত। সূর্যোদয়ের কিছু পর হতে সূর্য স্থির হবার (অর্থাৎ মাথার উপরে আসার ) পূর্ব পর্যন্ত।
ঈদের নামাজ কয় রাকাত এবং কোথায় পড়া উত্তম?
ঈদের নামাজ দু’রাকআত।
ঈদের নামাজ বড় ঈদগাহে (মাঠে) আদায় করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বদা ঈদের নামাজ মাঠে আদায় করতেন। তবে শরয়ী সম্মত কোন ওযর থাকলে ঈদের নামাজ মসজিদেও আদায় করা যায়। যেমনঃ বড় মাঠ না পাওয়া কিংবা মাঠে মুসাল্লিগণের স্থান সংকুলান না হওয়া কিংবা বৃষ্টি হলে ইত্যাদি। হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ এক ঈদের দিনে সেখানে বৃষ্টি হল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের নিয়ে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করলেন (আবূ দাউদ ও ইবনে মাযাহ)।